আজীবন বিপ্লবী কমরেড আবুবকর সিদ্দিক মোল্লা (তুলু)

মো. নজরুল ইসলাম

‘‘কৃর্তিমানের মৃত্যু নাই, বিপ্লবীদের ভয় নেই” গেল দশকের ষাটের দশক ছিলো বিশ্বের জাতি রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসের মাইলফলক। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতেও বৃটিশদের শোষন শাসনের যাতাকলে ভৌগলিক ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে দাঙ্গা ও কলহে অসংখ্য মানুষের জীবনাবাসন হয়েছে। বাঙ্গালি জাতিও সেই সকল রোষানলের শিকার হয়েছেন। সংকটকালীন এই সময়ে মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য অগ্রসরমান যে সকল সংগঠন জীবন দিয়ে লড়াই সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বামপন্থি সংগঠনগুলো অন্যতম। দেশ স্বাধীন হলেও মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্কা ও মানুষের অধিকার বাাস্তবায়িত হয়নি বরং পদে পদে মুক্তিযুদ্ধের চেতানা আদর্শের পদলেহন ও মৃত্যু ঘটছে। স্বাধীনতা পরবর্তী জাতি রাষ্ট্র গঠনে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে যে সকল দেশপ্রেমিক বীর সৈনিক মাটি কামড়ে থেকে মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আজীবন বিপ্লবী কমরেড আবুবকর সিদ্দিক মোল্লা (তুলু)।

মানিকগঞ্জ সাটুরিয়া উপজেলার হরগজ গ্রামের জমিদার আব্দুল আজিজ মোল্লা’র কনিষ্ট পুত্র কমরেড আবুবকর সিদ্দিক মোল্লা তুলু। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক শোষণ মুক্ত সমাজ বিনির্মানে উজ্জীবিত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তির মশাল বুকে ধারন করে লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
কমরেড তুলু মোল্লাকে আমি দেখিনি তবে তার স্মৃতিচারণ শুনেছি অনেক। মানিকগঞ্জের এই সময়ের প্রবীণ কমরেড বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. আজাহারুল ইসলাম আরজু, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. মিজানুর রহমান হযরত, সিপিবি জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি কমরেড নুরুল ইসলাম, সিপিবি বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক আবুল ইসলাম সিকদার,সাধারনণ সম্পাদক কমরেড মুজিবুর রহমান মাস্টার, কমরেড আব্দুল মান্নান,গবেষক মুজিবুর রহমান, উন্নয়ণকর্মী বিমল চন্দ্র রায় এর মুখে কমরেড তুলু মোল্লার বাবার জমিদারি নিয়ে পারিবারিক ইতিহাস ও সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করার ঘটনাগুলো বিভিন্ন ফোরামে মাঝে মাঝেই শোনা যায়। এছারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়েছেন রাশিয়া থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. বিজন সাহা, ডাকসুর সাবেক নেতা আবু আলী সিনা,প্রবীণ রাজনীতিক ও কলাম লেখক শেখর দত্ত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম নেতা মো. আলতাফ হোসাইন, কবি দিলওয়ার হাসান, উন্নয়ণকর্মী সিরাজুল ইসলাম, কমরেড সুব্রত তালুকদার,এস এম আসলাম রেজা, লায়ন আকতার হুসেইন, সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম বিশ^াস, এ্যাড. দিপক কুমার ঘোষ, মো. আব্দুল মান্নান মিয়া, কমরেড উষা মন্ডল, সাংবাদিক আব্দুল মোমিন, ব্যাংকার মো,শাজাহান, এ্যাড. আমিনুল ইসলাম আকবর, কামাল আহমেদ কমল, সেলিনা আক্তার, মাহবুব রুনু,নুর মোহাম্মদ, বাঁচিক শিল্পী কল্পনা সুলতান প্রমুখ।

দেশপ্রেম সামাজিক দায় ও দায়বদ্ধতা থেকে এই সকল বিপ্লবী মানুষের সংগ্রামী জীবনের গল্পগাঁথা ডকুমেন্টস করে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছরিয়ে দিতে আমি আনন্দবোধ করি। সেই লক্ষ্যে গতকাল ১ ফ্রেব্রুুয়ারী ২০২২ বিকালে হঠাৎ মানিকগঞ্জ থেকে আমি ও আমাদের প্রিয় কমরেড আব্দুর রাজ্জাক ভাই কে সাথে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ীতে যাই। আমাদের দেখেই তার সহধর্মীনি সামসুন নাহার এগিয়ে আসলেন এবং তার স্বামীর কথা বলাতেই মৃদু কেঁদে দিলেন। কিছুক্ষণপর তাহার আপ্যায়ন ও আমাদের আলাপন একসাথেই শুরু করলাম।
তিনি বলেন আমার স্বামী একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। দুরারোগ্য ব্যধিতে বড় অসময়ে আমার দুজন সন্তানকে রেখে পরপারে চলে যান। এই বাড়িতে আসার অল্পদিন পরই আমার শ্বশুর-শ্বাড়ুরিকে হারাই তারপর স্বামী এবং কয়েক বছর পরই আমার বড় ছেলেকে হারিয়ে আমি বেশ মর্মাহত ও ভেঙ্গে পড়েছি। এই বাড়িতে এখন আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে সকলের স্মৃতি ও ছায়া নিয়ে কোনমতে আমি বেঁচে আছি। কেউ খোজ খবর না রাখলেও আমি হতাশ নই এখন আমার একমাত্র পুত্র সৈকত সাজ্জাদ সিদ্দিকী এখন আমার কান্ডারী ও সবকিছু। ছেলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার্থী। বাড়ির জমিতে কৃষি কাজের পাশাপাশি বাবার মতোন সামাজিক রাজনৈতিক কাজে তার বেশ আগ্রহ। আমি যেতে দিতে না চাইলেও মানুষের বিপদে কাজ করে বসে থাকেনা।
কমরেড তুলু মোল্লা ১৩ জুন ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯ অক্টোবর ২০০৬ সালে মৃত্যুবরন করেন। তিনি মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সহিত বিএসসি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। চাকরি করার বেশ সুযোগ থাকলেও রাজনীতির নেশায় চাকরির প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিলো না। বাড়ির কৃষি কাজে সামান্য দেখাশুনা করতেন। অন্যদিকে বাবার জমিদারিরও তেমন খোঁজ- খবর রাখতেন না। মানিকগঞ্জের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড আজাহারুল ইসলাম আরজু এই বাড়িতে বেশি আসতেন। বলতে গেলে মূলত তার প্রেমে পরেই সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করতেন।
কমরেড তুলু মোল্লা ছাত্র জীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাতলে সামিল হয়ে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লাড়াই সংগ্রাম করেছেন। তিনি মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্যানেলে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব নিষ্ঠার সহিত পালন করছেন। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আশির দশকে মানিকগঞ্জে ভ‚মিহীনদের জন্য ক্ষেতমজুর, নয়াকান্দি বাঁধ কাটা ও স্বৈরাচরবিরোধী আন্দোলনসহ সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে কমরেড তুলু মোল্লা ছিলেন সামনের সাড়িতে।
আজ ভোগবাদী এই সমাজে স্রোতের বিপরীতে দড়িয়ে সাহস করে ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলার মতোন মানুষের খুবই অভাব। আমরা কমরেড আবুবকর সিদ্দিক তুলু মোল্লাদেরও বড়ই অভাব বোধ করি। শেষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে ত্যাগ তিতিক্ষা ও তার জীবনের মূল্যবান সময় কখনোই বিফলে যাবে না বরং সমাজ বদলের আন্দালন সংগ্রামের দীর্ঘ পথকে আরো সহজ ও সুগম করবে। নতুন প্রজন্ম তার আদর্শে উজ্জিবিত হয়ে অবশ্যই একদিন দিশা পাবে । আবারও কমরেড আবুবকর সিদ্দিক তুলু মোল্লার সৃষ্টি- কর্মের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও শতত লাল সালাম জানাই।