অ্যাপসের মাধ্যমে সরকারি ধান সংগ্রহ অভিযান প্রক্রিয়াটি অনিয়ম-দুর্নীতি রুখতে ব্যর্থ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃঅ্যাপসের মাধ্যমে সরকারি ধান সংগ্রহ অভিযান এবার মধ্যস্বত্বভোগীদের হটিয়ে দিলেও প্রক্রিয়াটি অনিয়ম-দুর্নীতি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে। খাদ্য গুদামে কর্মরতরা নানা কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের ভোগান্তির মুখে ফেলে তাদের কাছ থেকে ফায়দা লুটছে। অভিযোগ উঠেছে, ধান মাপার জন্য কৃষকদের বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। এমনকি ধান মাপার সময়ও ঠকানো হচ্ছে কৃষকদের। আর উৎকোচ আদায়ের জন্য নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ধানের আদ্রতা বেশি দেখানো হচ্ছে। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকরা গুদামে ধান দিতে এসে এভাবে নানান হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

যশোর শহরের রেলরোড এলাকার সরকারি খাদ্য গুদামে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ধানের আদ্রতা ঠিক নেই বলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নছিমন-করিমন ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে আসার পথে তাদেরকে ট্রাফিক পুলিশের কাছে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ধান নিয়ে শহরে ঢোকার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়াও কৃষকদের দাবি, খাদ্য গুদামের কর্মচারিদের দাবিকৃত টাকা দিলে, আদ্রতা ঠিক না থাকলেও ধান মেপে গুদামে তোলা হচ্ছে।

যশোর সদরের আরবপুর ইউনিয়নের পতেঙ্গালী থেকে আনোয়ার মোড়ল ৪৩ মন ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে আসেন। ধান মাপার সময় তার কাছ থেকে মণ প্রতি ২০ টাকা করে আদায় করা হয়। এছাড়া ধান মাপার পর তাকে ৩৯ মন ধানের দামের রশিদ ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে ৪৩ মন ধাণ মেপে এনেছিলাম। কিন্তু খাদ্য গুদাম মাপার পর সেটি ৩৯ মণ হয়েছে। কারসাজি করে আমাকে ৪ মণ ধানের দাম ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

এদিতে ধান দিতে আসা অনেক কৃষক জানান, আদ্রতা ঠিক নেই বলে ধান না নিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের দাবি, ইউনিয়ন সেবা কেন্দ্র থেকে মেপে আনা আদ্রতার সাথে খাদ্য গুদামের মাপা আদ্রতার সাথে মিলছে না। সদরের ইছালি ইউনিয়ন থেকে ধান নিয়ে আসা আব্দুল খলিল জানান, ৪০ মন ধান নিয়ে এসেছেন। আসার সময় ইউনিয়ন সেবা কেন্দ্রে যখন আদ্রতা মাপেন তখন সেটি ছিল ১৪’র নিচে ছিল। কিন্তু খাদ্য গুদামের যন্ত্রে মাপার পর একই গোলা থেকে আনা ধানের বস্তার কোনটির আদ্রতা শতকতা ১৫ ভাগ, কোনটির ১৪ দশমিক ৭ আবার কোনটির ১৪ দশমিক ৯ দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে ধান নিয়ে এসেছি। আদ্রতা ঠিক না থাকায় ধান নেয়নি গুদাম কর্তৃপক্ষ। এবার ধান ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য আবার ভাড়া গুনতে হবে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ধান রোদে দিয়ে শুকিয়ে ফের নিয়ে আসতে। তখনও ভাড়া বাবদ নগত টাকা গুনতে হবে। ফলে ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান দিয়েও খুব বেশি লাভবান হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

আব্দুর রাজ্জাক, হায়দার আলী, নূর ইসলামের মতন আরো অনেক কৃষককে ধানের আদ্রতা ঠিক না থাকার কথা বলে ফেরত পাঠানো হয়। আলাপচারিতায় এসব কৃষকরা জানান, এরপর থেকে কোন পদ্ধতিতেই আর সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দেবেন না। এবার দিন ধান শুকিয়ে আনার পরও যদি আদ্রতা ঠিক না থাকার অভিযোগ তোলা হয় তাহলে গুদামের সামনে রাস্তায় ফেল যাবেন বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ বলছে, ধান সংগ্রহের একটি নীতিমালা রয়েছে। সেটির আলোকেই সংগ্রহ চলছে। নিয়মানুযায়ী ধানের আর্দ্রতা সর্ব্বোচ্চ শতকরা ১৪ ভাগ থাকতে হবে। সেটি না থাকলে সেই ধান গুদামজাত করা যাবে না। কারণ এই রকম ধান বেশিদিন সংরক্ষন করা যায় না।

জানা যায়, গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ধান ক্রয় কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার ২ হাজার ৮২৬ মেট্রিকটন। কিন্তু এপর্যন্ত মাত্র জায়গায় মাত্র ২৭৫ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পুরণ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

ধান মাপার জন্য টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান জানান, ধান মাপা ও গুদামে তোলার কাজগুলো ঠিকাদারদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ধান মাপার সময় ঠিকাদারদের মজুররা টাকা দাবি করছে কেউ এমন অভিযোগ পেলে সেটি না নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ধান সংগ্রহে অনিয়ম দুর্নীতিন বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদ্রতা ঠিক না থাকলে কৃষকদের রোদে দিয়ে ধান শুকিয়ে আনতে বলা হচ্ছে। আজও ২৫ থেকে ৩০ জন কৃষককে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের ধানের আদ্রতা ঠিক না থাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। নিয়ম মেনে ধান সংগ্রহ অভিযান চলছে। কোন ধরণের অনিয়মা বা দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে না।

উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, যশোরে সদর উপজেলায় ‘কৃষক অ্যাপ’র মাধ্যমে আবেদন করে নির্বাচিত হওয়া কৃষকরা দুই হাজার ৮২৬ মেট্রিক টন ধান ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পারবে। এই কার্যক্রমের আওতায় যশোর সদর উপজেলার প্রায় আট হাজার কৃষক নিবন্ধন করেছিলো। লটারির মাধ্যমে ২ হাজার ১৮৮ জন কৃষক নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের আবাদী জমির অনুপাতে তাদের কাছ থেকে ধার কেনা হচ্ছে।