অমিতাভ ঘোষ-এর ‘গান আইল্যান্ড’

নন্দিতা বসু : অমিতাভ ঘোষ (জন্ম ১৯৫৬) সম্প্রতি ‘গান আইল্যান্ড’ (১৯১৯) নামে ইংরেজিতে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবিকা অর্জনের জন্য ভিন্ন দেশে গমন, পরিযায়ন এবং সেখানে বসবাসও উপন্যাসটির অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে। যদিওএর মূলে রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা মঙ্গলকাব্য জাতীয় আখ্যান, যার নায়কের নাম ‘বন্দুকী সদাগর’। মনসামঙ্গলের চাঁদসদাগরের কাহিনীর সঙ্গে এই বন্দুকী সদাগরের কাহিনীর মিল আছেঃ পূজোপ্রত্যাশী মনসা, চাঁদ ও ‘বন্দুকী’ সদাগর, এই দুজনের হাত থেকে পূজো পাবার জন্য দুজনকেই তাড়না করে বেড়িয়েছেন। সেই তাড়না করে বেড়ানোর গল্পই ‘গান আইল্যান্ড’-এর অন্যতম বিষয়বস্তু। পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চল উপন্যাসে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। প্রচলিত সংস্কার মতে বন্দুকী সদাগরের কাহিনীটির কোনো লিখিত রূপ নেই, যাতে এটি লিখিত না হয় এরকম আদেশ ছিল (বন্দুকী সদাগর নিজেই নাকি নিষেধ করেছিলেন যে কাহিনীটি যাতে লিখিত না হয়, গায়েনরা যেন মুখে মুখেই এটি প্রচার করেন)। মুখে মুখে প্রচারের কারণে কাহিনীর বয়নে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। কাহিনীর বয়ানটির আরম্ভ এরকম:
‘কলকাতায় তখন না ছিল লোক না মকান/ বাঙ্গলার পাটনী তখন নগর-এ-জাহান’। তারপর কাহিনী এভাবে এগিয়ে যায়:
অসম্ভব ধনী বন্দুকী সদাগর সমুদ্রবাণিজ্য করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সর্পদেবী মনসা, বন্দুকী সদাগরের কাছে পূজো চাইলেন যা করতে ঐ সদাগর সম্মত হলেন না। মনসাদেবী তখন খরা, দুর্ভিক্ষ, সাপের আক্রমণ ও অন্যান্য বিপদ দিয়ে আক্রমণ করে বন্দুকী সদাগরকে কাবু করতে চাইলেন। সদাগর তখন অনেক দূরের দেশ “বন্দুক দ্বীপ” এ পালিয়ে গেলেন (যার থেকে সদাগর নিজের নামের আগে ‘বন্দুকী’ অভিধাটি অর্জন করলেন)। নানা ঘটনার আবর্তনে সদাগর ক্রমে বহু দেশ, যেমন শিকল দ্বীপ, তালমিছরির দেশ, রুমালী দেশ অতিক্রম করলেন। কিন্তু মনসার হাত থেকে রেহাই পেলেন না। তখন তিনি সুন্দরবনে বিষ্ণুপুরী স্থাপত্যের অনুকরণে মাটির একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন যেটা ‘মনসার ধাম’ নামে পরিচিত। গান আইল্যান্ড আমাদের জানায় যে এই মন্দিরটা ১৯৪৭এর পর থেকে একজন মুসলমান মাঝি দেখাশোনা করতেন। মন্দিরটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে স্থানীয় লোকের বিশ্বাস। কারন ১৯৭০এর বীভৎস সাইক্লোন ‘ভোলা’র সময় ঐ অঞ্চলের লোক যাঁরা এই মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলো তাঁরা প্রাণে নাকি বেঁচে গিয়েছিলও।
অমিতাভ ঘোষ গান আইল্যান্ড -এ সারা পৃথিবীর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে খুব গুরুত্ত্ব দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের স্বল্পশিক্ষিত প্রায় অশিক্ষিত লোকদের বিদেশে চোরাপথ পাড়ি দিয়ে রোজগারপাতি করার দুঃখময়, জটিল, বিপদজনক সমস্যাকে। উপন্যাসের মধ্যে শেষ পর্যন্ত এই ভিন্ন ভিন্ন ধারাগুলি–মধ্যযুগে বন্দুকী সদাগরের দেশান্তর যাত্রা, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভিনদেশে পরিযায়ীউন্মুখ প্রায় অশিক্ষিত ভারতীয় বা বাংলাদেশী যুবকদের সামাজিক, আর্থিক অথবা সংস্কৃতিগত বিভিন্ন সংকটকে এক জায়গায় বেশ নিপূণভাবে পাঠকের কাছে সাজিয়ে তুলেছেন লেখক। তাতে উপন্যাসটি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সুন্দরবনের দরিদ্র, অশিক্ষিত জনসাধারণের কাছে বন্দুকী সদাগরের যে উপাখ্যানটি ছিল এক অলৌকিক গালগল্প, তা উপন্যাসে সাজানো ঘটনার সন্নিবেশে ঐতিহাসিক এবং পরিবেশবিজ্ঞগানীদের পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে তা আর গালগল্প নয়, এর পেছনে ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে।
কীভাবে?
না, মনসাদেবীর তাড়া খেয়ে বন্দুকী সদাগর যখন সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন পোর্তুগীজ হারমাদরা একদিন তাঁর জাহাজ লুট করে তাঁকে সর্বস্বান্ত করে অন্য কোনো দেশের বন্দরে নিয়ে গিয়ে ইলিয়াস নামের একজন নাখুদার (আরবদেশীয় বণিক, যিনি জাহাজের মালিকও বটেন) কাছে বিক্রী করে দেয়। নাখুদা ইলিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন যে বন্দুকী সদাগর অভিজ্ঞ ও চৌকোশ ব্যক্তি, যাঁকে সঙ্গে রাখলে আখেরে তাঁর লাভ বৈ লোকশান নেই। তাই তিনি বন্দুকী সদাগরকে সঙ্গে নিয়ে কড়ির দ্বীপ, শিকল দ্বীপ, তালমিছরীর দেশ, রুমালী দেশে গিয়ে বাণিজ্য করে প্রচুর লাভ করেন। গান আইল্যান্ড-এ দেখি সপ্তদশ শতাব্দীতে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস কেনার জন্য ইউরোপীয় বণিকদের কাছে কড়ির খুব চাহিদা ছিল, কারণ কড়িই ছিল আফ্রিকার ঐ অঞ্চলের মুদ্রা। নাখুদারাই ইয়োরোপীয়দের ওই কড়ির যোগান দিত। তাল মিছরির দেশ বলতে মিশর, (মিছরি তৈরির পদ্ধতি মিশর থেকে নাকি এসেছিল), ‘শিকলদ্বীপ’ বলতে ‘শিকিলা’ (আরবীয়রা সিসিলিকে এই নামে ডাকতো), গান আইল্যান্ড-এ বন্দুকী সদাগরের আখ্যানের অলৌকিক স্থানগুলিকে এভাবে ইতিহাসলগ্ন করা হয়েছে। বইটি আমাদের আরো জানাচ্ছে যে নানা জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে সেকালে ভেনিসে অনেক ইহুদী বণিকের আগমন হয়েছিল। (পাঠকের শেক্সপীয়রের ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এর কথা মনে পড়বে।) আশেপাশের অনেক দেশের সঙ্গে এই ইহুদীদের রমরমা বাণিজ্য ছিল আর আরবী ভাষায় তারা ছিল পারদর্শী। বাইজান্তিয়ানদের অনুকরণে ভেনিসকে নাখুদারা বলতো ‘বানাদিক’ (যেমন জার্মান বা সুইডিশরা বলতো ভেনেদিগ)। ধীরে ধীরে আরবী ‘বানাদিক’ ভাষাগত বিবর্তনের ফলে ‘আল-বুন্দিকিয়া’-তে পরিণত হল, এবং পারস্য, ভারতবর্ষ প্রভৃতি জায়গায় ভেনিস ‘আল-বুন্দিকিয়া’ নামেই পরিচিত ছিল। ‘বুন্দিকিয়া’/’বান্দিক’ শব্দে ‘বাদাম’, ‘বুলেট’, ‘বন্দুক’ এই তিন-ই বোঝায়। গান আইল্যান্ড-এর বয়ান মতে ভেনিসফেরত বণিক হিসাবে ‘বন্দুকী সদাগর’ তাঁর নামটি পেয়েছিলেন।
উপন্যাসটিতে অনেক অত্যাশ্চার্য ঘটনার সমাবেশ আছে, যেমন ইচ্ছাপূরণের ঘটনা রূপকথায় ঘটে। রফি আর টিপুর গল্পও সেরকম: বিদেশে পাড়ি দিতে সুবিধা হবে মনে করে রফি আর টিপু পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে চলে যায় তারা। সেখান থেকে দালালের পরিকল্পনা মতো বেশ বড়ো একটি দল চোরাপথে পশ্চিমবঙ্গে আসে, তারপর ভাঙাচোরা একটি ট্রাকের গোপন কুঠুরিতে বিহার উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব হয়ে পাকিস্থান, তারপর অনেক দিন ধরে দিনের বেলা কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে থেকে শুধু রাত্রিবেলা ধরে পায়ে হেঁটে আফগানিস্থান হয়ে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছোয়। এত লম্বা সফরে বার বার ওরা ভিন্ন ভিন্ন দালালরূপী ধূর্ত শেয়ালের হাতে পড়েছে। ইরান পর্যন্ত তাদের দালাল ছিল আফগান আর কুর্দ। সেখান থেকে রফিদের কুর্দিশ গ্রামের একটা আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আগে থেকেই অনেক ‘হাজারা’ আফগান, ইরানী আর পাকিস্তানী কর্মপ্রার্থী অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে তাদের ত্রিপলঢাকা একটি ট্রাকে বসানো হয়, বলা হয় ট্রাক একসময় থেমে যাবে, তক্ষুনি দৌড়ে পাহাড় ডিঙিয়ে টার্কিতে পৌঁছোতে হবে। কিন্তু জায়গাটা অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল। কারণ সীমান্তরক্ষীরা লোকচলাচলের শব্দ পেলেই গুলি ছুঁড়ছিল। তাড়াতাড়ি ছুটতে গিয়ে টিপুর পা মচকে গেল, রাতের অন্ধকারে রফি কিছু জানতেও পারলো না। টার্কির ওই জায়গা থেকে বাসে করে ইস্তামবুলের কাছাকাছি এসে বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়া থেকে ট্রেনে করে ইটালি হয়ে রফি ভেনিসে পৌঁছোয়। ইস্তামবুলের কাছাকাছি যেখানে রফি বাস থেকে নেমেছিল সেখানে দেখেছিল যে ইরাক, সিরিয়া, আফগানগানিস্তান, সোমালিয়া, পাকিস্তান অনেকেই চোরাপথে ইয়োরোপে পাড়ি দেবার জন্য জড়ো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টিপুও একটা বড়ো দলের সঙ্গে নৌকা করে ভেনিসে পৌঁছেছিল, কিন্তু সে ছিলো এক বিরাট বিরাট অভিযাত্রা, মানবাধিকারের এক দুর্দান্ত লড়াই, যে লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল মানবঅধিকারলাভার্থী বহু স্থানীয় মানুষ।
অমিতাভ ঘোষ গান আইল্যান্ড উপন্যাসে, আগে যেমন বলেছি, যে জলবায়ু পরিবর্তন, অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পরিযায়ন এবং অতীত সভ্যতার সঙ্গে এই দুটি প্রসঙ্গের যোগসূত্র স্থাপন করে উপন্যাসের বিষয়বস্তুর গুরুত্ত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন, যদিও গল্পের ঘোড়া অনেক সময়েই গাছে উঠে পড়েছে। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ, আজ সেটা থাকুক। সুযোগ হলে বারান্তরে একদিন এই আলোচনা হবে।
কিন্তু যে কথাটা না বললেই নয়, তা হলো, ধূর্ত দালালদের সীমাহীন অমানবিক ব্যবহার সত্ত্বেও এ উপন্যাসে বন্ধুত্বের নরম ছোঁয়া মনকে ভীষণ ভাবে উথাল পাথাল করে দেয়। ভাবা যায় যে জীবনযুদ্ধে হাঙরের সঙ্গে লুটোপুটি খেতে খেতেও বিলাল কবীরকে ভুলতে পারেনি, নিজের রোজগারের টাকা সে সমান ভাবেই ভাগ করে নেয়, কবীরের পরিবারের সঙ্গে। সেরকমই টিপু আর রফির সম্পর্ক, চরম বিপদ দুজনকে স্থানগতভাবে আলাদা করলেও ভালোবাসার শক্ত দড়িতে দুজন দুজনকে সাংঘাতিকভাবে কষে রাখে। খুব আলতোভাবে অমিতাভ ঘোষ সমাজের বড়ো বড়ো পাহাড়গুলো ডিঙিয়ে গেছেন, কিছু কিছু ঘটনার গড়ন এমনভাবে দিয়েছেন যে মনে হয় এরকম ভাবে ছাড়া ঘটনাগুলি আর কীভাবে ঘটতে পারতো? যেমন মুসলমান হয়েও রফির বাবার ‘মনসার ধাম’-এর দেখাশোনার দায়িত্ব পাওয়া অথবা রফি টিপুর ঘনিষ্ঠতা। আরো উদাহরণও দেওয়া যায়।
‘গান আইল্যান্ড’ ইংরেজিতে লেখা বলেই বহু পাঠকের নজর কাড়বে, বিশেষত এর লেখক যখন অমিতাভ ঘোষ। আবহাওয়া ঊষ্ণায়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমস্যা যে সমস্যার দ্রুত সমাধান না ঘটাতে পারলে খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু যে সমস্যাটা ভারতীয় বা বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ছাড়া সমাজের আর কাউকে গ্রাস করছে না তা হলো অল্পশিক্ষিত ব অশিক্ষিতের বিদেশে পরিযানের সমস্যা, হাড় মাংস কালি করে, নিজেদের প্রাণ হাতে নিয়ে গরীব মানুষরা লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে, এই লাগামছাড়া অবিচারের সুরাহা কি কোনোদিন হবে না? বন্দুকদ্বীপ কি পারবে না সেই পথে দু’একটা নুড়ি বিছিয়ে দিতে?