অনিয়ম করে ঋণ দিয়ে ঠেকে গেছে রূপালী ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক: রপ্তানিকারকদের সহায়তা করতে ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), যেখান থেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য উদ্যোক্তাদের ডলারে ঋণ দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যারা এই তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের অনেকেই তা ফেরত দেয়নি বা দিতে পারছে না। এর মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে থার্মেক্স গ্রুপ।

জানা গেছে, থার্মেক্স গ্রুপকে এই এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেয় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সেই ঋণ আর ফেরত দেয়নি থার্মেক্স গ্রুপ। বাধ্য হয়ে বিদেশি মুদ্রার ঋণটিকে ফোর্সড লোনে রূপান্তর করে রূপালী ব্যাংক।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি বলছে, সময়মতো ঋণ ফেরত না দেওয়ায় শিল্প গ্রুপটি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। তবে সেই ঋণ বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল করে দায় পরিশোধের সময়ও বাড়িয়েছে ব্যাংকটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে এমন অনিয়মের তথ্য। অনিয়ম সংশোধন করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত ৫ মে রূপালী ব্যাংককে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু সংশোধন না করে থার্মেক্সের একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রমের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য ৪ জুন আবারও অনুরোধ জানিয়েছে রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইডিএফ ফান্ড থেকে থার্মেক্স গ্রুপকে ৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলেও তা শোধ না করায় বাধ্য হয়ে থার্মেক্স গ্রুপের নামে সুদে-আসলে মোট ৭১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ফোর্সড লোন সৃষ্টি করেছে রূপালী ব্যাংক।
বর্তমানে মাসিক কিস্তিতে আগামী ছয় মাসে এই ঋণ পরিশোধের আবেদন করেছে থার্মেক্স। তার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনুমতি চেয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পাশাপাশি এই ৭১ কোটি ৭৩ লাখ এবং থার্মেক্স গ্রুপের অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিস্টার ডেনিম কম্পোজিট লিমিটেডের নামে নেওয়া ১৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিতে না পারলে তাদেরকে মন্দমানে খেলাপি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এই ঋণের মাধ্যমে রূপালী ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা অর্থাৎ মূলধনের ২৫ শতাংশ (ফান্ডেড-ননফান্ডেড) অতিক্রম করেছে থার্মেক্স।

বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রূপালী ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল বা মূলধন ছিল ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। বিধিমতে কোনো একক গ্রাহক বা গ্রুপকে ৫৫৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই তাদের। থার্মেক্স গ্রুপের মোট ঋণ রূপালী ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ গ্রুপটি রূপালী ব্যাংকের একটি বৃহৎ গ্রাহক।

কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদনে বৃহৎ গ্রাহকের তালিকায় নাম নেই থার্মেক্সের। ৩৬৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া গ্রাহক নোমান স্পিনিং মিলসের নাম বৃহৎ গ্রাহকের তালিকায় থাকলেও কেন থার্মেক্সের নাম নেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রূপালী ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটি থেকে থার্মেক্স গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার আশপাশে ছিল। কিন্তু নতুন করে ৮৩ কোটি ৭৯ লাখ (৬৬.২৭ ও ১৭.৫২) টাকা যুক্ত হয়ে ঋণের সমষ্টি একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের বরখেলাপ।

ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ব্যাংকের মূলধন সরকারের দেওয়া মূলধন পুনর্ভরণের অর্থ ও স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত বেড়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৪৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল ২ হাজার ২২৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন (এমসিআর) ৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।

পোশাক ও বস্ত্র খাতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন আবদুল কাদির মোল্লা। শতভাগ রপ্তানিমুখী এই শিল্প গ্রুপে থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস, থার্মেক্স স্পিনিং, থার্মেক্স নিট ইয়ার্ন, থার্মেক্স ইয়ার্ন ডাইং, থার্মেক্স ওভেন ডাইং, আদুরি অ্যাপারেলস, আদুরি নিট কম্পোজিটসহ আন্তর্জাতিক মানসম্মত ১৬টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমানে তিনি বেসরকারি খাতের সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের একজন পরিচালক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এই বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কোনো ব্যাংক যদি আইন লঙ্ঘন করে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তবে ইডিএফের ঋণ খেলাপি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ নির্ধারিত সময় শেষে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই টাকা কেটে নেয়।

তিনি বলেন, কোনো ব্যাংক যদি অনিয়মের মাধ্যমে ফোর্সড লোন তৈরি করে, সেই ঋণ খেলাপি হয়ে যায় এবং নীতিবহির্ভূতভাবে পুনঃতফসিল করে, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।