নড়াইলের লোহাগড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্টে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠার পর সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল থানা পুলিশ। কথিত ওই অভিযোগের জেরে যাতে সংখ্যালঘুদের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতা যাতে হামলা না করতে পারে সেজন্য উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার পশ্চিম-দক্ষিণ অংশে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। কারণ অভিযুক্ত আকাশ সাহার বাড়ি সাহাপাড়ার এ অংশে। পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ছিল কঠোর নজরদারি।
পুলিশের সতর্কতার কারণে পশ্চিম-দক্ষিণাংশে সুবিধা করতে না পেরে অবস্থান পাল্টায় হামলাকারীরা। হঠাৎ করেই তারা সাহাপাড়ার পূর্ব দিকে চলে যায়। এরপর মন্দির ও বাড়িঘরে শুরু হয় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের তাণ্ডব।
প্রশাসন বিষয়টি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই চারটি মন্দিরসহ ১৭টি বাড়ি-ঘর ও দোকানপাটে চলে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। একটি বাড়ি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, শুরুতেই তরুণ সাহা নামে এক ব্যক্তির ঘরে হামলা করা হয়।
ভুক্তভোগী তরুণ সাহা বলেন, “ফেসবুকে পোস্টের কথিত অভিযোগে অভিযুক্ত আকাশ সাহার বাড়ি সাহাপাড়ার দক্ষিণাংশে। তাই ঘটনাটি ছড়ানোর পর উত্তেজনাও দেখা দেয় ওই অংশকে ঘিরে। এ কারণে শুরুতে পুলিশ ওই পাশেই সক্রিয় ছিল এবং তারা সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে।”
তিনি বলেন, “”এদিকে, ঘটনার শুরু থেকেই সাহাপাড়ার পূর্বাংশ পুলিশি নজরদারির বাইরে ছিল। সেই সুযোগে হামলাকারীরাও এদিকে ঢুকে দোকান ও বাড়ি-ঘরে হামলা চালায়।”
তাণ্ডবের বর্ণনা
তরুণ সাহা জানান, হামলাকারীরা তার ঘরের টিনের চাল ও দুটি দরজা ভেঙে ফেলে। এরপর একে একে দিলীপ মাস্টারের বাড়ি ও পারিবারিক মন্দির হামলা ও লুটপাট চালায়, গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, ডা. স্বপনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে, পারিবারিক মন্দিরের প্রতিমা ভেঙে ফেলে।
এভাবে হামলা করতে করতে তারা পুরো সাহাপাড়া তছনছ করে।
এরপর তারা পেছন দিক থেকে সাহাপাড়ার দক্ষিণাংশে আখড়ার সর্বজনীন মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করে। হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় নবগঙ্গার তীরবর্তী শ্মশান মন্দিরে।
হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ জনের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, অনুপম সাহার দোকানের শাটার ভাঙা ও ওষুধ নষ্ট হওয়াসহ ৩ লাখ টাকা, গোবিন্দ চন্দ্র সাহার টিনের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়াসহ ২ লাখ টাকা, দিলীপ কুমার সাহার (দিলীপ মাস্টার) টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণালংকার ও রান্না ঘরসহ ২ লাখ টাকা, দিঘলিয়া শশ্মান কালিমাতা মন্দিরের গেট, টাইলস, টিউবওয়েল, কংক্রিটের তৈরি কালী প্রতিমা ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়ায় ২ লাখ টাকা, শচিদানন্দ রায়ের মন্দিরের গ্রিল ও প্রতিমা ভাঙা এবং দুটি গরু নিয়ে যাওয়ায় দেড় লাখ টাকার ক্ষতি, দিঘলিয়া রাধা গোবিন্দ মন্দিরের ৫০টি চেয়ার, সাউন্ড বক্স, গেট, জিনিসপত্র নষ্ট হওয়ায় দেড় লাখ টাকার ক্ষতি, আখড়াবাড়ি সর্বজনীন মন্দিরের গেট, টিনের চাল ও প্রতিমা ভাঙচুরে এক লাখ টাকা, গৌতম সাহার দোকানে শাটার ভাঙা ও মিষ্টি নষ্ট হওয়ায় ৪০ হাজার টাকা, গোবিন্দ কুণ্ডুর দোকানে শাটার ভাঙা ও মিষ্টি নষ্ট করায় ৪০ হাজার টাকা, অশোক সাহার দোকানের শাটার নষ্ট হওয়ায় ২০ হাজার টাকা, স্বপন কুমার সাহার মন্দিরের গ্রিল ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় ২০ হাজার টাকা, উত্তম ঘোষের দোকানের শাটার নষ্ট হওয়ায় ১৫ হাজার টাকা, বিপ্লব কুমার সাহার পানির ট্যাঙ্ক, টিনের চাল ও বৈদ্যুতিক মিটারসহ ১৫ হাজার টাকা, গৌরচন্দ্র সাহার ঘরের দরজা, শোকেসসহ মালামাল নিয়ে যাওয়ায় ১৫ হাজার টাকা, নিত্যদুলাল সাহার দোকানের সাটার ও ঝাপ পাল্লা নষ্টে ১৫ হাজার টাকার ক্ষতি, তরুণ সাহার ঘরের দরজা ও ঘরের জিনিসপত্রসহ ১০ হাজার টাকা এবং পদ্মরানী চক্রবর্তীর বৈদ্যুতিক মিটার নষ্ট করায় ৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সংঘাত নয় ‘নির্যাতন’
তরুণ সাহার অভিযোগ, “সাহাপাড়ার চারপাশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। অপরিচিতদের পাশাপাশি পরিচিতরাও এ হামলায় যুক্ত ছিল।”
তার মতে, “এ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বলা হচ্ছে, যা সঠিক নয়। কারণ, সংঘাত হতে হলে দু’পক্ষের সক্রিয়তা প্রয়োজন। কিন্তু এ ঘটনাটি ছিল একতরফা।”
এ কারণে ১৫ জুলাইয়ের ঘটনাকে হিন্দু নির্যাতন বলাই তার কাছে যৌক্তিক।
তরুণ সাহা বলেন, “কারণ এ ঘটনায় কেবলমাত্র সাহাপাড়ার হিন্দুরাই নির্যাতিত হয়েছেন। বাজারে কোনো মুসলিমের দোকানে হামলা হয়নি। সেখানেও হিন্দুদের দোকানেই হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “হঠাৎই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আর তা মুহূর্তের মধ্যেই হিন্দু পরিবারগুলোর জন্য বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে।”
সেদিনের ঘটনার আরেক ভুক্তভোগী গোবিন্দ সাহা জানান, সন্ধ্যার পরই হামলাকারীরা অতর্কিতে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির সব মালামাল পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পর প্রতিবেশীরা এসে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে তৎপর হয়। কিন্তু আগুন নিভতে নিভতে ঘরের সব কিছু শেষ হয়ে যায়।
সরকারি কর্তৃপক্ষ তার ঘর ঠিক করার ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন নতুন করে তার ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।
হামলার পর হুমকি
সাহাপাড়ার বাসিন্দা মালা রানী সাহা বলেন, “আমার ঘরটি রাস্তার সাথে হওয়ায় শুরুর দিকেই হামলার কবলে পড়ে। হামলাকারীরা ঘরে থাকা চার ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং চার হাজার টাকা নিয়ে গেছে। আলমারি ভাঙার চেষ্টা করেছে।”
তিনি জানান, ১৮ জুলাই দিবাগত রাতে একটি পক্ষ বাড়ি এসে তাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, ঘরে হামলা বা লুটতরাজ হয়নি বলে বলতে হবে। না হলে ক্ষতি হতে পারে।
আখড়ার বাসিন্দা মলিনা রায় অভিযোগ করে বলেন, “ঘটনার পরদিন (১৬ জুলাই) দিবাগত রাতে একদল লোক এসে তার গোয়াল ঘর থেকে দুটি গরু জোর করে নিয়ে গেছে। এ কারণে তারা এখন বাড়ির লোকজন ও অন্যান্য সম্পদ নিয়ে উদ্বিগ্ন।”
সূত্রপাত
দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার অশোক সাহার ছেলে আকাশ সাহা ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে কটূক্তি করে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ১৫ জুলাই বিকেলে একদল লোক আকাশকে গ্রেপ্তারের দাবিতে এলাকায় মানববন্ধন করে।
পরে উত্তেজিত জনতার একটি অংশ দিঘলিয়া বাজারের নিত্য দুলাল সাহা, অনুপ সাহা, অশোক সাহা, সঞ্জিৎ সাহার মুদি দোকান এবং গোবিন্দ কুণ্ডু ও গৌতম কুণ্ডুর মিষ্টির দোকানে ভাঙচুর চালায়।
এরপর শুরু হয় সাহাপাড়ার বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ।
খবর পেয়ে লোহাগড়া থানা পুলিশ, গোয়েন্টা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে র্যাব-৬-এর একটি দল এবং নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর রায় ঘটনাস্থলে যান। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।