আস্থার সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠান

ডেস্ক রিপোর্ট: আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের পর পুরো খাতে সাধারণ আমানতকারীদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। প্রভাব পড়ছে দেশে বিদ্যমান ৩৩টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। এ প্রেক্ষিতে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা। চলমান বিস্তারিত জানাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন তারা।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, চলমান সংকটের কারণে আমানতকারীরা অর্থ তুলে নিচ্ছেন। তাদের একটি চেকও যাতে ডিজঅনার না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর। এনবিএফআই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারে, যদি তারল্য সহায়তা দিয়ে তাদেরকে সংকট মুক্ত করা যায় সেটা কীভাবে হবে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহায়তা কিভাবে পাবো এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গভর্নর এগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, একটি দুটি প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো খাতের বদনাম যাতে না হয়, মানুষের আস্থা যাতে বহাল থাকে সেজন্য বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থা নেয়ার কথা গভর্নরকে জানিয়েছেন তারা।

মুমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ইতোমধ্যে ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চরম তারল্য সংকটের বিষয় সবার সামনে এসেছে। কিন্তু এর বাইরেও অনুরূপ আরও ২৯টি প্রতিষ্ঠান আছে। এই দুর্বল ৫টি প্রতিষ্ঠানের কারণে যাতে বাকি ২৯টি প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে না পড়ে সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয়া যায় এসব বিষয়ে গভর্নরের দিকনির্দেশনা পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ভালো থাকে সেজন্য আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সব ধরনের পলিসি সাপোর্ট দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া চলমান সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদানও কম নয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের অবস্থাও তো এমন হয়েছে, কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি প্রথম ঘটনা হওয়ায় কারও মধ্যে যাতে আতংক তৈরি না হয় সেটিও খেয়াল রাখা হচ্ছে।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সব সহায়তা করবে। যদি ব্যাংকের মাধ্যমে তারল্য সহায়তা দেয়া, সেটি হতে পারে স্বল্প মেয়াদি। অথবা ফান্ড ম্যানেজম্যান্টে সাহায্যের দরকার হলে সব ধরনের সহায়তা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দিচ্ছে। পিপলসের কারণে ব্যাংকের আমানত যাতে উত্তোলন না করা হয় সেসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। যেহেতু বড় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ভূমিকা পালন করতে চাইছে সেজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সহায়তাও চেয়েছে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান ভালো আছে তারা যাতে দুর্বলদের তারল্য সহায়তা দেয়। আর চেক অনার করার কথা বলা হয়েছে। আমানতকারীদের কেউ অর্থ চাইলেই যাতে পায়। কোনো চেক যাতে ফেরত না যায় বৈঠকে সে বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা ক্ষণস্থায়ী। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে যেতে হবে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোতে বন্ড মার্কেট, বন্ড ইসু্য, বন্ড সিকিউরিটাইজেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জিরো কুপন বন্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যাক্স রেট কমানোর ব্যাপারে এনবিআরকে বলা হয়েছে। জিরো কুপন বন্ডে এ সরকার ইতোমধ্যে করহার কমিয়েছে। আগে অবশ্য জিরো কুপন বন্ডে করমুক্ত ছিলো।

জানা গেছে, দেশের ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি বিভাগও রয়েছে। কিন্তু দেশের ব্যাংক খাতের চেয়ে আর্থিক খাতের অবস্থা বেশ নাজুক বলে বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়ে আসছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছেছে কয়েক বছরে। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। এর বাইরে শুধু রাজনৈতিক কারণে কয়েকটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থায় ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ওপর নজরদারি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সিদ্ধান্তের আলোকে তথ্য নেয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের। বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া পিপলস লিজিংয়ের। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৫০ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন কম রয়েছে ২০ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানও এতটাই সংকটে পড়েছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) মতো টাকা নেই। যে কারণে গত বছর এক কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অডিটর গতকাল মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালের অডিট রিপোর্টের ওপর বিশেষ পর্যবেক্ষণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, যা পূরণের সক্ষমতা না থাকায় বিশেষ বিবেচনায় পাঁচ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রিমিয়ার লিজিং নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব বছরে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে। পর্যায়ক্রমে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ২৪ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি। সরকারি মালিকানার ইডকলের খেলাপি ঋণ ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত বছর সাড়ে ১৬ কোটি টাকা লোকসান করা প্রাইম ফাইন্যান্সের ঋণের ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ খেলাপি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ১৫ দশমিক ৪১ শতাংশ, মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ের ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি।